প্রতিমা সজ্জায় সতীশ চন্দ্র পাল

গতকাল রাতে খাওয়ার সময় মা একটা সুন্দর ভাতের হাঁড়ি দেখিয়ে বললো -“জানিস, এটা সতীশ পাল ছিল না, ওর ছোট ছেলের দোকান থেকে কেনা|”
“কোথায় দোকান দিয়েছে?”
“যাদবপুরে| একদিন গেছিলাম, এইসব করোনার আগে, বাবা দেখে চিনতে পেরে সবার খোঁজ নিচ্ছিল| সব ভাইদের…কি যেন নাম চারটে ভাইয়ের, তোর বাবা জানে|”
“এখন কোথায় থাকে ওরা? “
“সব নাকি গড়িয়া, বোড়াল ঐসব দিকে চলে গেছে…”
লেক গার্ডেন্স -যোধপুর পার্ক অঞ্চলের যারা পুরোনো বাসিন্দা তারা হয়তো মৃৎ শিল্পী সতীশ পাল এবং তাদের প্রতিমা গড়ার জায়গাটির সাথে পূর্ব পরিচিত| এখন যেখানে সাউথ সিটি ডায়গনোস্টিক ল্যাবরেটরি, সেখানেই ছিল সতীশ পাল| আমাদের এক টুকরো ছোটবেলা|
আমাদের পাড়া ‘কল্যাণ সংঘের’ পুজো হাল ফ্যাশনের থিম, জাকজমক আর কর্পোরেট স্পন্সরশিপের সামনে নিতান্তই সাদামাটা ভাবে সম্পন্ন হয়| কিন্তু আমাদের একটা অত্যন্ত অহংকার ও গর্বের বিষয় হলো যে আমাদের পাড়ার পুজোয় এখনো প্রাণ আছে| আর এই প্রাণ ভরা আনন্দের সূত্রপাত, এই কিছুদিন আগেও হতো সতীশ পালের গড়া ঠাকুরের মধ্যে দিয়ে| যেই দেখতো সেই বলতো, তোদের পাড়ার ঠাকুরের চোখটা প্রত্যেকবারই এমন অসাধারণ হয়, মনে হয় যেন প্রাণ আছে| ষষ্ঠীর দিন দেবী মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার সাথে, সাথেই সেই যে আমাদের মাতৃমূর্তির মুখের আদলে আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির উমাকে খুঁজে নেওয়ার অসাধারণ নৈকট্য, এ সম্মান ও আদরে সতীশ পাল ও তার অন্যান্য কারিগর/ শিল্পীরা আমাদের প্রত্যেকবার ভরিয়ে তুলতেন| নবমীর দিন আমাদের সবসময় মনে হতো মায়ের চোখটা যেন ছলছল করছে|
নব নালন্দা স্কুলের যোধপুর পার্ক শাখায় আমার বড় স্কুল জীবনের হাতে খড়ি| স্কুলের পাশেই ছিল আমার ‘আন্টির বাড়ি’| আর বাড়ি লেক গার্ডেনসে| বলা বাহুল্য, আসতে যেতে, পায়ে হেঁটেই আমার এই জায়গা গুলোর নাড়ি নক্ষত্র চেনা| যেমন চেনা পাঞ্জাবি গ্যারেজ, সতীশ পাল বা পাড়ার মোড়ের খুবই জনপ্রিয় ধোসার দোকান|
আগে প্রত্যেক বার নিয়ম করে 15 আগস্ট আমাদের পুজোর মিটিং হতো| তারপর পাড়ার সবাই মিলে যেত সতীশ পালের কাছে ঠাকুর বায়না দিতে| আর স্কুল বা টিউশন ফেরত সেই ঠাকুর পাড়ার বন্ধুদের থেকে সবার আগে দেখার সে যে কি উত্তেজনা থাকতো আমার, তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না| আর ঠাকুর তৈরী হচ্ছে দেখে আসার পর, কাজ কতখানি এগোলো, চোখ আঁকা হলো কিনা এই সব খুঁটিনাটি দেখতে স্কুল ফেরতা বা শনি, রবিবার বাবার হাত ধরে টিউশন ফেরতা আমার লাগামহীন আনন্দের ভাষার ব্যাকরণ আমি এখন অনেকটাই ভুলে গেছি| স্মৃতি বলে আনন্দ গুলো ছিল নিখাদ|
স্মৃতির অতলে ডুবসাঁতার দিলে মনে পরে যায় যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন ঐরকম বড়, বড়, সারি, সারি সাজানো ঠাকুর আর টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাল্বের আলো আঁধারির মধ্যে, দিনের বেলাও বেশ গা ছমছম করতো| মনে হতো সিংহটা যদি আসল হয়? বা অসুরটা যদি জীবন্ত হয়ে ওঠে?
কি আশ্চর্য, পঞ্চমীর দিন পাড়ার মণ্ডপে সেই ঠাকুরের আগমনের সাথে, সাথেই আবার মনে কি খুশির জোয়ার| সেই সিংহ কেই তখন মনে হয় বন্ধু| দশমীর দিন বিদায় বেলায় সিংহ আর অসুর দুজনকেই মার বরণের ডালা থেকে সন্দেশ তুলে মুখ ভর্তি করে খাইয়ে দিতাম| মনে, মনে ওদেরকেও বলতাম -“আবার এসো কিন্তু সামনের বছর|”
আর ছিল পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাইকে ঘোষণা করার ধুম| বাবার শেখানো বুলিতে বলতাম, “কল্যাণ সংঘের তরফ থেকে আগত সমস্ত দর্শনার্থীদের জানাই শারদীয়ার প্রীতিও শুভেচ্ছা| আমাদের প্রতিমা সজ্জায় সতীশ চন্দ্র পাল…”
ঘুম ভাঙার আগে স্বপ্ন দেখার সময় যেমন একটা আবছায়া গোছের তন্দ্রা মতন হয় – অনেক কিছুই মনে থাকে, আবার অনেক কিছুই মনে থাকে না| সেইরকমই স্মৃতির অতলে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও তাই মনে রয়ে গেছে প্রতিমা সজ্জায় ‘সতীশ চন্দ্র পাল’ বলাটা অপরিবর্তিত থাকতো সব সময়|
পুজোটা আমাদের এখনো হয়, কিন্তু সতীশ পাল আর আমাদের প্রতিমা শিল্পী নন| তাও হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর| লেখা পড়া, চাকরি, সংসার এর রেসের মাঝে একদিন জানতে পারলাম আমাদের ছোটবেলার ধ্রুব সত্যটা পাল্টে গেছে| ওনার ছেলেরা কেউ এই পেশার সাথে যুক্ত থাকতে চাননি আর| তাই বাবার মৃত্যুর পর, ছেলেরা প্রোমোটারের কাছে জমিটা বিক্রি করে দিয়ে টাকা নিয়ে এধার ওধার বাড়ি ঘর করে চলে গেছে| মৃৎ শিল্পের সাথে কারোরই বিশেষ যোগাযোগ আর নেই শুনেছি| আর আমার ছোটবেলার অপার বিস্ময় আর নিখাদ আনন্দের জায়গা জুড়ে এখন ঝা চকচকে একটা ফ্ল্যাট বাড়ি আর ডায়গনস্টিক সেন্টার|
ভালো খারাপের দ্বন্দে না গিয়ে শুধু শৈশবের মানচিত্রটা বদলে যাওয়ার গল্পটা মনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার নামই বোধহয় জীবন|

Leave a comment