সেদিন কে একজন বলছিল – “কি রে বাংলায় লেখা বন্ধই করে দিলি নাকি?”
আমি বললাম – “জানোই তো আজকাল এস ই ও, ব্লগ হিটসের এর বাজার। এরমাঝে আমার প্যানপ্যানানি বাংলা লেখা কে পড়বে বলোতো?”
“কেন রে বংপেন তো দিব্যি বাংলায় লেখে”
“কি যে বলোনা? কিসের সাথে কিসের তুলনা?”
একথা, সেকথায়, কথা হারায়, আমারও বাংলা লেখা হয়ে ওঠেনা আজ বহুকাল। এরমাঝে আমার নতুন ব্লগঠিকানা হলো, নিজের নামে। নতুন ফেসবুক পেজ হলো ব্লগের, আরো কত কি…
কিন্তু এই যে খেরোর খাতা, মনের ডায়েরি, যেখানে নিজের গল্প করব বলে এই ব্লগবকম শুরু আমার, সেখানেই আর নিজের বলা বোঝার সব থেকে স্বাবলীল ভাষায় আর কিছু লেখাই হয় না আমার।
যারা আমার ব্লগ পড়েন তারা হয়তো জানেন যে কিছুদিন আগে আমরা একটা নতুন বাড়িতে শিফট করেছি। নিজেদের কেনা প্রথম বাড়ি। বলতে পারেন, মনের রঙ মিশিয়ে সাজানো। আজকাল কেউ বাড়িতে এলেই ঘুরে ঘুরে তাদের ঘর দেখাই – “এইটা কেমন হয়েছে বলো? আর ওইটা”।
তারা চলে যাওয়ার পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি দেওয়ালে কোথাও অসাবধনতায় দাগ লাগল নাতো? ইস! সোফাটার কি অবস্থা। আমার মা তো রেগে বলেই দিলেন – “কেউ তোর বাড়ি আসবে না নাকি?”
যারা আমায় চেনেন তারা ভালো করেই জানেন আমার ঘর সাজানো, বা পরিপাটি থাকা নিয়ে খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই। বলতে পারেন, আমি বেশ অগোছালো। আমার মার তা নিয়ে খুব দুঃখ ছিল একসময়। আমাদের দক্ষিণ কলকাতার বাড়িটার যখন তিনতলা হলো, আমার মা বাবাকে দেখতাম সারাদিন এরকম বাড়ি বাড়ি করে মাথা খারাপ করতে।
আমার বোন বা আমি দেওয়ালে একটা আঁচর কাটলেই কপালে ছিল বেদম পিট্টি আর বকাঝকা। তখন মনে হতো মার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আহা! বোন না হয় ভুল করে এবিসিডি খাতায় লেখার জায়গায় দেওয়ালেই লিখে ফেলেছে। কি আশ্চর্য! আজ এতোবছর বাদে মার করা নিখুঁত ভবিষ্যৎ বানী যেন হাতে নাতে ফলে গেল – “নিজের যখন হবে তখন বুঝবি।”
মার বচন যেন খনার বচন কেও হার মানায়!
এই তো গেলো নতুন বাড়ির গল্প।
অফিস কাছারীও মোটের ওপর ভালোই চলছে, আমাদের ডেডলাইন সর্বস্ব ঝা চকচকে কর্পোরেট দুনিয়ায় যেমন চলে আর কি। তবে কি জানেন তো, আমার অফিসের ঠিক নীচেই এক ম্যাজিশিয়ান রোজ বিকেলবেলা এসে কেরামতি দেখায়।
ম্যাজিশিয়ান পেশায় ফুচকা বানায়, আর তার ঝাল কটকটে আলুমাখাটা বানায় আরো ভালো। ম্যাজিশিয়ানই বটে নয়তো সারাদিন ক্লায়েন্টের গুঁতো খেতে খেতে বিধ্বস্ত আমার পুরো মুডটাই ভালো হয়ে যায় এক লহমায়।
মনে আছে যখন হায়দ্রাবাদ ছেড়ে কলকাতা ফিরছি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে, সবাই অনেক বোঝাল – “কেরিয়ারের শুরুতেই এতো ভালো সুজোগ, এতো বড় অফার, কলকাতা গেলে কিচ্ছু পাবি না।”
আমি জানিনা আমার বয়সী কোন মেয়ে ওই জায়গায় থাকলে কি করতো, কিন্তু আমার তখন দুটোই কথা ঘুরছে মাথায়। বিয়ে করবো আর কলকাতায় ফিরবো।
কলকাতায় ফিরে ফিরেই জব হান্টিঙের দিন গুলো খুব কষ্টের গেছে। ন্যাশনাল ল স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছি আমি সদ্য, ক্যাম্পাসে এক নামজাদা এম এন সির খুব ভালো অফার ছিল, আর তাকে কিনা কলকাতায় এসে ৬ মাস ঘরে বসে থাকতে হবে, এই সত্যিটা মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল।
বলতে নেই, ওই বয়সে, ঠিক ওই মুহূর্তে আমার ওই “গ্রাউন্ডিং” টার খুব দরকার ছিল। আর আমাকে হাতে ধরে সেই কথাটা শিখিয়েছিল কলকাতা।
শহরটার ওপর রাগ যে হয়না বলব না। সত্যিই তো, ভারতবর্ষের অন্য কোনো শহরে থাকলে হয়তো আমি আজ এর তিন গুন মাইনে পেতাম, কাজের পরিধি অনেক বড় হোত, সেগুলো কি আমায় সত্যিই দিতে পেরেছে শহরটা?
ম্যাজিশিয়ানদের দিয়ে কি সেই না পাওয়া গুলো ভরাট করা যায়?
তবে একটা ব্যাপারে আমি সবসময় কলকাতার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকুব। একজন কবিয়াল লিখেছিলেন – “এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু”। প্রথম বলতে আমাদের মাথায় কি আসে? – প্রথম প্রেম, প্রথম কলেজে যাওয়ার দিনটা, প্রথম প্রেম ভাঙা।
আমার কাছে এই প্রথমের উত্তরসূরিতে যোগ দিয়েছে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা, প্রথম বিশ্বাসভাঙা।
আমার জীবনের প্রথ্যেকটা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার গল্পে যাদের সবসময় কাছে পাবো ভেবেছিলাম, তেমনি কিছু স্বজন বন্ধুদের খুব বিপরীত একটা মুখ, একটা চরিত্র আমাকে আজকাল দেখাচ্ছে কলকাতা।
বিশ্বদীপ, প্রথাগত ভাবে যাকে সবাই আমার বিবাহিত (হত না হিত, এটা ওই ভালো বলতে পারবে) স্বামী বলে জানে, আর আমি জানি “প্রিয় বন্ধু” হিসেবে, সে আমাকে মাঝে মাঝে বলে – “ওপরে ওঠার রাস্তাটা বড্ড নিরিবিলি, বড্ড একা।” বয়সে ও খানিকটা বড় আমার থেকে, অভিজ্ঞতাতেও, হয়তো বা সেই সূত্রেই বলতে পারে।
কলকাতায় না থাকলে এই সংকীর্ণতা, কাঁকড়া স্বরুপ যে ব্যবহারের জন্যা বাঙালি জন্য বিখ্যাত তাও হয়তো দেখা হতো না আমার। আগে খুব রাগ হতো, কান্না পেতো, এখন একরাশ ঘৃণা আর মাথার মধ্যে “ইগনোর, ইগনোর” ঘুরতে থাকে।
জীবনের চলার পথে এতবড় সত্যিটাও আমায় কিন্ত কলকাতাই হাতে ধরে শেখালো। অন্য জায়গায় থাকলে শিখতাম না, তা নয়। কিন্তু কাছের মানুষ দের এহেন তঞ্চকতা, মনের কাছের কাঁচে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
Poushali, wonderfully penned. I love reading your lines.
LikeLike
Thanks 🙂 That phone call made my Sunday.
LikeLiked by 1 person